গিগ ইকোনমি বা গিগ অর্থনীতি বর্তমান সময়ে এমন একটি ধারণা, যা বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং হিসেবে বেশ পরিচিত। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে মানুষ ইন্টারনেট বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে আয় করতে পারে। শুধু ফ্রিল্যান্সার নয়, চাকুরিজীবীরাও তাদের মূল কাজের পাশাপাশি এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।

গিগ ইকোনমিতে কাজের স্বাধীনতা উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী। একজন ফ্রিল্যান্সার নিজের পছন্দমতো কাজ, সময়সূচী এবং কাজের জায়গা নির্ধারণ করতে পারেন। অন্যদিকে, নিয়োগদাতারা শুধু নির্দিষ্ট কাজ বা সময়ের জন্য অর্থ প্রদান করেন, ফলে তাদের পূর্ণকালীন কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবা বা পেনশনের মতো অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হয় না। এ ছাড়াও, গিগ ইকোনমির আওতায় রয়েছে ডিজিটাল ব্যবসা, উদ্যোক্তা কার্যক্রম এবং ডিজিটাল লেনদেন, যা এই অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করে তুলছে।


গিগ ইকোনমি বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে ছোট ছোট কাজ বা প্রকল্পভিত্তিক কাজের জন্য ফ্রিল্যান্সার বা স্বতন্ত্র ঠিকাদারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ধরনের কাজ সাধারণত অস্থায়ী হয় এবং নির্দিষ্ট সময় বা নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করার পর শেষ হয়ে যায়।

গিগ ইকোনমি কী?

গিগ ইকোনমির মূল আকর্ষণ হলো এর স্বাধীনতা। এখানে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ বেছে নিতে পারেন, কাজের সময়সূচী নিজের মতো ঠিক করতে পারেন এবং যেখানে ইচ্ছা সেখান থেকে কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে, নিয়োগদাতারা পূর্ণকালীন কর্মীর পরিবর্তে কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী ফ্রিল্যান্সারদের নিয়োগ দিয়ে খরচ কমাতে পারেন।

উদাহরণস্বরূপ, গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, রাইড শেয়ারিং, বা ফুড ডেলিভারির মতো কাজগুলো গিগ ইকোনমির অন্তর্ভুক্ত। এই অর্থনৈতিক মডেলটি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

কেন এমন নামকরণ?

“গিগ ইকোনমি” শব্দটি এসেছে বিনোদন জগত থেকে, বিশেষ করে সংগীতশিল্পীদের কাজের ধরন থেকে। আগে সংগীতশিল্পীরা প্রতিটি পারফরম্যান্স বা “গিগ” এর জন্য আলাদা পারিশ্রমিক পেতেন। প্রতিটি কাজ বা পারফরম্যান্স ছিল স্বতন্ত্র এবং স্বল্পমেয়াদী।

এই ধারণা থেকেই গিগ ইকোনমি নামটি এসেছে, কারণ এখানে কাজগুলোও ঠিক একই রকম। ফ্রিল্যান্সার বা কর্মীরা নির্দিষ্ট কাজ বা প্রকল্পের জন্য পারিশ্রমিক পান এবং কাজটি শেষ হলে তাদের দায়িত্বও শেষ হয়ে যায়। এটি মূলত স্বল্পমেয়াদী কাজের একটি স্বাধীন ব্যবস্থা, যা আজকের যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আরও সহজ হয়ে উঠেছে।

বিশ্বে গিগ ইকোনমির প্রভাব

গিগ ইকোনমি বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি শুধু চাকরির প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিচ্ছে না, বরং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। আজকের বিশ্বে প্রায় ৫.৩ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, যা গিগ ইকোনমির জন্য বিশাল একটি বাজার তৈরি করেছে।

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গিগ ইকোনমির আকার প্রায় ৪৫৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী কাজের নতুন সুযোগ তৈরি করছে, বিশেষ করে যেখানে প্রযুক্তি সহজলভ্য। গিগ ইকোনমির এই প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে এটি শুধু অর্থনীতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সমাজ ও শ্রমবাজারের জন্যও নতুন দিক উন্মোচন করছে।

কেন মানুষ ঝুঁকছে গিগ ইকোনমিতে?

মানুষ গিগ ইকোনমির দিকে ঝুঁকছে কারণ এটি কাজের স্বাধীনতা এবং আয়ের নতুন সুযোগ দেয়। এখানে কাজের সময় ও স্থান বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে, যা প্রচলিত চাকরির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গিগ ইকোনমি মানুষের দক্ষতা ও প্রতিভাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ দেয়। এছাড়া, যেসব মানুষ মূলধারার চাকরিতে সুযোগ পান না, তারাও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আয় করতে পারছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মানুষ এখন গিগ ইকোনমির মাধ্যমে বৈশ্বিক কাজের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে।

এই কারণে গিগ ইকোনমি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক মডেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

গিগ ইকোনমির সুবিধা ও অসুবিধা

সুবিধা:
গিগ ইকোনমির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর নমনীয়তা। আপনি নিজের পছন্দমতো কাজ বেছে নিতে পারেন এবং কাজের সময় নির্ধারণ করতে পারেন। এটি একাধিক কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়, যা আপনাকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাদার হতে সাহায্য করে। এছাড়া:

  • ইচ্ছামতো কাজ করে আয় করা যায়।
  • মূল চাকরির বাইরে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ মেলে।
  • ঘরে বসে বা দূর থেকে কাজ করার সুবিধা পাওয়া যায়।
  • দক্ষতা অনুযায়ী উপযুক্ত কাজ বেছে নেওয়া যায়।

অসুবিধা:
গিগ ইকোনমির মূল চ্যালেঞ্জ হলো এর অনিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা। বেশিরভাগ গিগ কর্মীকে অপরিচিতদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, যা অনেক সময় মানসিক চাপে পরিণত হয়। এছাড়া:

  • কাজের পরিমাণ কম থাকলে আয়ও কমে যায়।
  • স্বাস্থ্যবীমা বা অবসরকালীন সুবিধা পাওয়া যায় না।
  • কাজ শেষ করার পরেই কেবল পারিশ্রমিক পাওয়া যায়।
  • অতিরিক্ত কাজের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি (বার্নআউট) হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন ডেলিভারি ড্রাইভার হিসেবে কাজ করলে অতিরিক্ত কাজের চাপ আপনার ফ্যামিলি লাইফ এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই গিগ ইকোনমি যেমন অনেকের জন্য স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে এসেছে, তেমনি এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

গিগ ইকোনমির প্রকারভেদ

গিগ ইকোনমি বিভিন্ন ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। এই কাজগুলোকে প্রধানত চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়:

১. অ্যাসেট বা সম্পদ শেয়ারিং পরিষেবা

এ ধরনের গিগে মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিভিন্ন সম্পদ ভাড়া দেয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • ঘর বা রুম শেয়ারিং (Airbnb, HomeWay)।
  • গাড়ি শেয়ারিং বা ভাড়া দেওয়া (Turo)।
  • নৌকা, পার্কিং স্পেস বা সরঞ্জাম শেয়ার করা।
    এই মডেলে সম্পদ ভাগাভাগির মাধ্যমে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয়।

২. পরিবহনভিত্তিক পরিষেবা

এগুলো এমন গিগ যেখানে ফ্রিল্যান্সার ড্রাইভাররা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাজ করেন। যেমন:

  • রাইড শেয়ারিং (Uber, পাঠাও)।
  • কার পুলিং (BlaBlaCar)।
  • ফুড ডেলিভারি বা গ্রোসারি বিতরণ (Doordash, Careem)।
    এই ধরনের কাজের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, কারণ মানুষ দ্রুত এবং সহজ সেবা পেতে চায়।

৩. পেশাদার পরিষেবা

এটি মূলত সেই কাজগুলো, যা ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে সরাসরি ক্লায়েন্টদের সাথে করা হয়। যেমন:

  • মাইক্রোওয়ার্ক বা ক্ষুদ্র কাজ।
  • বিজনেস একাউন্টিং।
  • ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, কোডিং।
  • অনুবাদ বা ট্রান্সলেশন।
    এ ধরনের কাজের জন্য জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে UpWork, Fiverr, Guru।

৪. হস্তশিল্প ও গৃহস্থালীর পরিষেবা

এখানে ঘরে বসে তৈরি পণ্য বাজারজাত করা হয় এবং বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়া হয়। যেমন:

  • হস্তশিল্প বিক্রি (Etsy)।
  • টিউশনি বা বেবি সিটিং।
  • হোম নার্সিং এবং পোষা প্রাণীর যত্ন।
  • ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট।
    এই সেবাগুলো “Handmade Goods and Household Services” নামে পরিচিত এবং ঘরে বসে আয় করার দারুণ সুযোগ তৈরি করে।

এভাবে, গিগ ইকোনমি বিভিন্ন ধরনের কাজের প্ল্যাটফর্ম ও পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের জীবনে নতুন সম্ভাবনা যোগ করছে।

গিগ অর্থনীতিতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ গিগ ইকোনমি বা শেয়ারড অর্থনীতির ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছে। রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অ্যাপভিত্তিক নানা কাজে তরুণ প্রজন্ম সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে গিগ ইকোনমিতে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

বিশ্বের ফ্রিল্যান্সিং বাজারে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। কর্মী সরবরাহে বাংলাদেশ ১৬ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা মাসিক গড়ে ৬০ মার্কিন ডলার আয় করেন। এই খাতটি তরুণদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের বড় একটি সুযোগ এনে দিয়েছে, এবং দেশের অনেকেই এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন।

ব্যক্তিগতভাবে, আমি বিশ্বাস করি গিগ অর্থনীতি তরুণদের দক্ষতা বাড়ানোর এবং নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। এ লক্ষ্যে আমি আমার ইউটিউব চ্যানেল Digital Deep Dive-এ বাংলায় ফ্রি ভিডিও টিউটোরিয়াল তৈরি করছি। পাশাপাশি, বিভিন্ন ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে।

গিগ ইকোনমির ভবিষ্যৎ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গিগ ইকোনমি দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, কারণ বিভিন্ন গিগ ইকোনমি অ্যাপ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তুলছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় গিগ ইকোনমির চাহিদা আরও বেড়েছে। মানুষ তখন বাড়ি থেকে কাজ করছিল এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য হোম ডেলিভারির ওপর নির্ভর করছিল। এই পরিস্থিতি গিগ ইকোনমিকে ভবিষ্যতের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা “মেরুদণ্ড” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

গিগ ইকোনমির ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। এক জরিপ অনুযায়ী, ৮৬% ফ্রিল্যান্সার মনে করেন যে গিগ ইকোনমির সেরা দিন এখনও আসেনি। এটি দেখায় যে তারা এর উন্নতি এবং প্রসারের বিষয়ে আশাবাদী। ডেটা বিশ্লেষণেও এই বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে যে, গিগ ইকোনমি এমন কর্মীদের জন্য লাভজনক যারা দীর্ঘমেয়াদী চাকরির পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদী কাজ করতে পছন্দ করেন।

এছাড়া, গিগ ইকোনমি বিভিন্ন কোম্পানিকে বৈচিত্র্যময় এবং উদ্ভাবনী প্রতিভা নিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে। কোম্পানিগুলো বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে দক্ষ ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজ করতে পারছে, যা তাদের লাভজনক ও কার্যকর করছে। তাই, গিগ ইকোনমি শুধু কর্মীদের জন্য নয়, বরং নিয়োগদাতাদের জন্যও সমানভাবে লাভজনক।

Leave a comment

Trending