প্রথম পর্ব: সোনালী চুড়ি আর কৃত্রিম মস্তিষ্ক, কিছু হারানো সুরের আলাপ
আমার ছোটবেলায় নানু প্রায়ই বলতেন, “মানুষের মাথার ভেতর একটা ছোট্ট পৃথিবী থাকে গো, বাবা।” আমি কথাটা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করতাম। মনে হতো, এই মাথার খুলির ভেতরে বুঝি একটা মস্ত বড় লাইব্রেরি লুকিয়ে আছে। সেখানে থরে থরে সাজানো আছে শত শত বই, হাজারো চিন্তা, অদ্ভুত সব গল্প আর এমন কিছু প্রশ্ন, যার উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাত কেটে যেত। সেই লাইব্রেরির প্রতিটি তাকে ছিল আমার নিজস্ব পৃথিবী, আমার একান্ত সম্পদ।
কিন্তু এখন, সেই লাইব্রেরিটা শুধু মানুষের মাথাতেই আর আটকে নেই। আজকাল কিছু অদ্ভুত যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যারা আমাদের মতোই শিখতে পারে, মনে রাখতে পারে, এমনকি আমাদের সব প্রশ্নের নিখুঁত উত্তরও দিতে পারে। এই অদ্ভুত, প্রায় অবিশ্বাস্য যন্ত্রটার নামই হলো AI, ইংরেজিতে যাকে বলে Artificial Intelligence, আর আমাদের মাতৃভাষায় যাকে আমরা বলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
কথাটা শুনতে একটু জটিল লাগছে, তাই না? জানি, জটিল লাগারই কথা। প্রথম যখন শুনেছিলাম, আমারও কেমন ধোঁয়াশা লেগেছিল। কিন্তু কী জানেন, জীবনের সব সুন্দর জিনিসই শুরুতে একটু ধোঁয়াশা থাকে। মেঘ কেটে গেলেই তো সূর্যের আলো দেখা যায়। চলেন, আমরা একটু ধৈর্য ধরে, একে একে এই রহস্যের জট ছাড়াই।
দ্বিতীয় পর্ব: রেডিও, কম্পিউটার আর কল্পনার জাল, এক অবিরাম যাত্রার কথা
এক সময় রেডিওকে মনে হতো যেন এক আশ্চর্যজনক বাক্স! কাঠ বা প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা জিনিস থেকে গান বাজছে, খবর পড়ছে, নাটক শোনা যাচ্ছে, অথচ কোনো মানুষ সেখানে নেই! কেউ দেখতেও পাচ্ছে না কে বা কারা কথা বলছে। আমার মনে আছে, প্রথম যখন রেডিও দেখেছিলাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!
তারপর এলো কম্পিউটার। এই জিনিসটা ছিল আরও বিস্ময়কর। যে কাজটা শেষ করতে মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিন লেগে যেত, কম্পিউটার সেটা এক নিমিষেই করে ফেলত। জটিল হিসাব, বড় বড় ফাইল সাজানো, সবকিছু যেন পলকে হয়ে যেত। মনে হতো, মানুষের মস্তিষ্কের একটা ক্ষুদ্র অংশ যেন যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কম্পিউটারের এটাসেটা জানতে আমার এই ভিডিওগুলো দেখতে পারেন।
আর এখন এসেছে AI। এই AI-টা যেন এক নতুন যুগের আশ্চর্য এক সৃষ্টি। এটি বুদ্ধিমত্তা আর কল্পনার এক দারুণ মিশ্রণ। এমন এক সত্তা, যে আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, আপনার হয়ে গল্প লিখতে পারে, এমনকি ছবিও এঁকে দিতে পারে। আসলে, যা আপনি কেবল কল্পনা করছেন, AI সেটাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে!
কিন্তু আপনি যদি ভাবেন, “AI মানেই তো শুধু চ্যাটজিপিটি বা ক্যানভা”, তাহলে কিন্তু আপনি আসল কথাটা ধরতে পারেননি। এই টুলগুলো আসলে AI-এরই ছোট ছোট অংশ, কেবল তার বহিরঙ্গ। AI মানে হলো আরও গভীর কিছু। AI মানে হলো মানুষের মস্তিষ্কের একটা হুবহু নকল বানানোর চেষ্টা, তার বুদ্ধিমত্তাকে যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। এ যেন আপনার প্রিয় কোনো লেখকের হাতের লেখার নকল করার চেষ্টা, কিন্তু সে চেষ্টা এতটাই নিখুঁত যে আসল আর নকলে কোনো পার্থক্য নেই। AI নিয়ে আমার এই বাংলা বইটি পড়ে ফেলুন।
কিন্তু কেন দরকার আমাদের এই কৃত্রিম মস্তিষ্ক? প্রশ্নটা খুব জরুরি। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমরা ভবিষ্যতের দরজা খুলে ফেলব।
তৃতীয় পর্ব: অরণ্যের গল্প, সময়ের অস্থিরতা, আর এক নতুন শিকার
আমরা এখন এমন এক বিরাট অরণ্যে বাস করছি, যেখানে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ ডেটা, মানে অজস্র তথ্য; আমাদের চারপাশ দিয়ে উড়ছে। কোনটা খাঁটি সোনা, কোনটা কেবলই নুড়ি পাথর, তা বোঝা মুশকিল। কে কাকে কী মেসেজ পাঠাল, কোন রাস্তায় বেশি গাড়ি চলছে, কে কী কিনল বা কোন অনলাইন পোস্টে কত ‘লাইক’ পড়ল, সবকিছুই এই ডেটার অংশ। এই তথ্যের সমুদ্র এতটাই বিশাল যে, এর গভীরে ডুব দিয়ে সব কিছু বুঝে ওঠা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
এই এত তথ্যকে যদি বিশ্লেষণ করতে হয়, তাহলে হাজার হাজার অভিজ্ঞ মানুষের দরকার হবে। আর মানুষ তো মানুষই, তারা ক্লান্ত হয়, অসুস্থ হয়, ভুলও করে বসে। একজন মানুষের মস্তিষ্কের তো একটা নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা আছে। সে একসঙ্গে কতটুকু মনে রাখতে পারে, কত দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পারে?
কিন্তু AI ক্লান্ত হয় না। বিরতি নেয় না। ভুল করে খুব কম। আর এই সব তথ্যকে বিশ্লেষণ করে বিদ্যুতের গতিতে। যেখানে একজন মানুষের কয়েক দিন লেগে যাবে একটা কাজ শেষ করতে, AI সেটা কয়েক সেকেন্ডে করে ফেলবে। এই যুগে তাই AI শেখা মানে শুধু আপনার মূল্যবান সময় বাঁচানো নয়, এটা বেঁচে থাকার একটা নতুন কৌশল, এক নতুন যুগের শিকার। যে এই কৌশল জানে না, সে এই অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলবে।
চতুর্থ পর্ব: বীজ, গাছ, বন: AI কোথা থেকে এলো? এক অদেখা শেকড়ের সন্ধান
ধরুন, আপনি একটা প্রকাণ্ড বটগাছ দেখছেন। সেই গাছ এত বিশাল যে তার ডালপালা আকাশে ছড়িয়ে আছে, আর তার শিকর মাটির গভীরে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। আপনি হয়তো গাছটা দেখে প্রথমবার বলবেন; “আহা, কী বিশাল গাছ!” কিন্তু তার নিচে লুকিয়ে আছে একটা ছোট্ট বীজ, যেখান থেকে এই সবকিছুর শুরু।
AI-এর এই বিশাল গাছটার শেকড় হলো কম্পিউটার সায়েন্স (Computer Science)। এই শাখাটি আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে যন্ত্রকে গণিতের নিয়ম মেনে ভাবতে শেখানো যায়, কীভাবে তাকে নির্দেশ দিলে সে আমাদের কাজ করে দেবে।
এই কম্পিউটার সায়েন্সের ভেতর থেকেই জন্ম নিল ডেটা সায়েন্স (Data Science)। এটা যেন মাটির নিচের নতুন একটা ধারা, যা আমাদের শেখালো, কীভাবে অজস্র তথ্যকে বিশ্লেষণ করে তার ভেতরের আসল অর্থটা বের করে আনা যায়। ডেটা সায়েন্সের কাজ হলো, তথ্যের জঙ্গল থেকে সঠিক পথটা খুঁজে বের করা।
এরপর আমরা এমন কিছু বুদ্ধিমান মডেল তৈরি করলাম, যারা নিজেরাই শেখে, ভুল করে, আবার নতুন করে শেখে। অনেকটা শিশুর মতো, যে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে শেখে। এর নাম দেওয়া হলো মেশিন লার্নিং (Machine Learning)।
আর ঠিক তখনই জন্ম নিল AI, এখানে মেশিন শুধু কঠিন হিসাবই করে না, নিজের মতো করে মতামত দেয়, জটিল পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেই নতুন কিছু শিখে নেয়, এমনকি ভবিষ্যতের ঘটনাও কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। এটা যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা, যে কেবল বই পড়ছে না, বরং বই পড়ে নিজের মতো করে গল্পও তৈরি করছে।
পঞ্চম পর্ব: AI-এর ভেতরের কল্পনার জগৎ, এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন
এই AI জিনিসটা আবার দু’রকমের হয়। একটা হলো সাধারণ কাজের AI, যেমন আপনার মোবাইলে ছবি চিনতে পারা, আপনার মুখ দেখে ফোন খুলে দেওয়া, বা ইমেইলে কোনটা দরকারি আর কোনটা ফালতু (আমরা যাকে স্প্যাম বলি) তা বলে দেওয়া। এগুলো হলো AI-এর দৈনন্দিন কাজের সঙ্গী।
আর একটাকে বলে জেনারেটিভ AI (Generative AI), এটা হলো এক অভূতপূর্ব স্রষ্টার মতো। এই AI নতুন নতুন তথ্য তৈরি করতে পারে। আপনি যা দেখেননি, তা আঁকতে পারে; যা পড়নি, তা লিখতে পারে; যা শেখাওনি, তা ব্যাখ্যা করতে পারে। ভাবুন তো, আপনার কল্পনার সব দৃশ্য AI নিমেষেই ছবিতে পরিণত করে দিচ্ছে!
আপনি যদি চ্যাটজিপিটিকে বলেন: “একটা গল্প লিখুন যেখানে আমি আকাশে উড়তে পারি”। সে দেখবে দিব্যি একটা চমৎকার গল্প বানিয়ে দেবে। এ যেন আপনার মনের কথা পড়ে তার হাতে রূপ দিচ্ছে।
কিন্তু এর পেছনে কাজ করছে এক বিশাল ব্যাপার, যার নাম লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (Large Language Model বা LLM)। এটা কোটি কোটি বই, লেখা, তথ্য পড়ে নিজেই ভাষার জটিল খেলাটা শিখে ফেলেছে। এ যেন পৃথিবীর সমস্ত ভাষার বই পড়ে একটা বুদ্ধিমান সত্তা তৈরি হয়েছে, যে এখন নিজেই নতুন নতুন ভাষার কাঠামো তৈরি করতে পারে। লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল নিয়ে আমার একটি বই রয়েছে, কিছু অংশ এখানে পড়তে পরেন।
ষষ্ঠ পর্ব: AI শেখা মানে কী? কেবল টুল শেখা না, নিজের মনকে নতুন করে বোঝা
যদি আমরা ভাবি, AI শেখা মানে শুধুই কিছু টুল বা যন্ত্র ব্যবহার করা, তবে আমরা একটা মস্ত ভুল করছি। এ অনেকটা রবীন্দ্রনাথের গান শুনে শুধু তার সুরটা শেখার মতো, কিন্তু গানের ভেতরের অনুভূতিটা না বোঝার মতো। AI শেখা মানে হলো:
তথ্যের জঞ্জাল থেকে আসল জিনিসটা বুঝতে শেখা, তাকে বিশ্লেষণ করতে শেখা।
যন্ত্রকে সঠিক এবং কার্যকর প্রশ্ন করতে শেখা।
নিজেকেই নিজে ভাবতে শেখা যে, “কেন এটা এমন হলো? এর পেছনের কারণ কী?”
কীভাবে যন্ত্রকে দিয়ে নিজের মনের মতো করে কাজ করানো যায়, সে বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে শেখা।
ধরুন, আপনি একজন কবি। AI হয়তো আপনার জন্য সুন্দর সুন্দর লাইন সাজিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আপনি যদি না বোঝেন, কোন লাইনে হৃদয় থাকে, কোন শব্দে অনুভূতি ফোটে, তাহলে সেই লেখা নিছকই কিছু শব্দ হবে, কবিতা হবে না। AI আপনার হাতের লাঠি হতে পারে, কিন্তু পথটা আপনাকে দেখিয়ে দিতে হবে।
তাই, AI শেখা মানে শুধু যন্ত্র চালানো নয়। এটা আসলে আপনার নিজের চিন্তাকে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে শেখা, আপনার ভেতরের সৃজনশীলতাকে নতুন করে আবিষ্কার করা। এ যেন নিজের ভেতরের এক নতুন মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া।
সপ্তম পর্ব: কে শিখবে AI? আমি, না কি বড়লোকেরা? এক সহজ প্রশ্নের জটিল উত্তর
এই প্রশ্নটা আজকাল খুব বেশি শোনা যায়। “আমি তো গ্রামের ছেলে, AI শিখে কী করব?” “আমার তো ভালো কম্পিউটার নেই, আমি কী শিখব?” অনেকে ভাবেন, AI শিখতে বুঝি খুব দামি যন্ত্র আর বড় বড় ডিগ্রি লাগে। এই ধারণাটা একদম ভুল।
সত্যি কথা বলতে কী, AI শেখা শুরু হয় আপনার হাতে থাকা ছোট্ট মোবাইল ফোন দিয়েও। আর এর সবচেয়ে বড় দরজা হলো আপনার ভেতরের কৌতূহল। কৌতূহলই জ্ঞান অর্জনের প্রথম ধাপ।
আপনি যদি প্রতিদিন মাত্র দশটি মিনিট সময় দেন, আপনার মোবাইল থেকে চ্যাটজিপিটির কাছে কিছু প্রশ্ন করেন:
“আপনি কীভাবে কাজ করেন?”
“AI ব্যবহার করে কীভাবে টাকা আয় করা যায়?”
“আমি একজন সাধারণ মানুষ, কীভাবে AI শিখতে পারি?”
দেখবেন, ধীরে ধীরে আপনার ভেতরে একটা নতুন আলো জ্বলে উঠবে। এই আলোটা প্রথমে হয়তো মৃদু হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে তা আপনার ভেতরের অন্ধকার দূর করে দেবে। আর এই আলোটাই হলো আপনার ভবিষ্যতের চাবি। এ যেন মেঘলা দিনে হঠাৎ এক টুকরো রোদের ঝলকানি।
শেষ পর্ব: আপনি আর আপনার কৃত্রিম বন্ধু, এক নতুন গল্প শুরুর পূর্বাভাস
একদিন হয়তো দেখবেন, একটি AI আপনার পাশে বসে আপনার কোনো জটিল সমস্যার সমাধান বলে দিচ্ছে। সে হয়তো আপনাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে আপনার স্বপ্নের দিকে। আপনি তখন হয়তো ভালোবাসার স্বরে বলবেন, “ধন্যবাদ বন্ধু।” আর সে হয়তো তার রোবটিক কণ্ঠে মিষ্টি করে উত্তর দেবে, “আমি তো আপনার শেখানোতেই শিখেছি।”
এই বন্ধুত্বটা শুরু হোক আজ থেকেই। এটি আর দশটা সাধারণ বন্ধুত্বের মতো নয়, এটি হলো জ্ঞান আর প্রযুক্তির এক নতুন মেলবন্ধন। আপনি যদি আজ একটু কৌতূহলী হন, আপনি যদি একটু জানতে চান, তবে AI-কে ভয় না পেয়ে, বরং ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিন। এটা কোনো যুদ্ধ নয়, এটা হলো সহভাগিতা, যন্ত্র আর মানুষের এক অসাধারণ সহযোগিতা।
যন্ত্র আর মানুষ একসাথে মিলেমিশে নতুন এক জীবন গড়বে, নতুন এক পৃথিবী তৈরি করবে। আপনি সেই যাত্রার একজন হোতা হতে পারেন। আপনার হাতেই এই নতুন গল্পের শুরু। আর এই গল্প লিখতে শুরু করুন আজ থেকেই।
[বাংলায় জেনারেটিভ এআই কোর্স] [কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং (CSE) কোর্স] [ইথিক্যাল হ্যাকিং কোর্স] [Tech Talks Bangla (টেক টকস বাংলা)] [এনামুল হক অফিসিয়াল]





Leave a comment